বুধবার, ২১ জুলাই, ২০১০

বস্তু, শক্তি ও গুণের প্রসঙ্গে আত্মা বা মন সম্পর্কিত ভাবনা

হেগেলের তিনটি সূত্র আছে যেগুলো সাধারনভাবে তাঁর অন্যতম ছাত্র মার্ক্সের নামে প্রচারিত। পরিমাণের গুণে রূপান্তর হলো দ্বিতীয় সূত্র।

বস্তুর ‘নির্দিষ্ট’ পরিমাণ ঘটলে নতুন গুণের আগমন ঘটে। যেমন: একটি ঘড়ির প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ গুলোকে ‘নির্দিষ্ট’ভাবে একত্রিত (সংযোজন অর্থে) করলে নতুন একটাকিছু পাওয়া যায় - সময়।

এই দৃষ্টিতে গুণ বস্তুকে আশ্রয় করে থাকে বটে তবে তা বস্তু-অতিরিক্ত, কিন্তু বস্তু-নিরপেক্ষ বা স্বাধীন নয়। গুন বস্তুর অংশও নয়। ঘড়ির যন্ত্রাংশের মধ্যে সময় বলে কোন পার্টস নাই।

গুণ, বস্তু’র থেকে আলাদা কিনা - এই নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্ক রয়েছে।
মার্কসিস্টরা মনে করেন, মন হলো মস্তিস্কের উপজাত বা বাই-প্রডাক্ট। মন, দেহকে প্রভাবিত করতে পারেনা। দেহই মনকে গঠন করে। এই তত্বের বিপক্ষে অনেক আলোচনা আছে। সেসব এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। মার্ক্স-এর মতানুসারে মন-এর স্ট্যাটাস বস্তু’র গুণের সমতুল্য।

মন নিয়ে প্রাচ্যের চিন্তাধারায় ব্যাপক ভেরিয়েশান আছে। মন ও আত্মা কে আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয়। ইংরেজীতে মাইন্ড, সৌল, স্পিরিট - ইত্যাদি আলাদা শব্দ থাকলেও তত্ত্বীয় আলোচনাতে সব কিছুকে মাইন্ড বা মন হিসাবে ট্রিটমেনট করা হয়।

গূণ-কে যদি বস্তুনির্ভর কিন্তু বস্তুর অতিরিক্ত (যেমন ঘড়ি ও সময়ের ধারনা) হয় তাহলে বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিজ্ঞান ‘প্রাণ’ সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেও আত্মা’র ধারনা নাকচ হয়ে যাবে না। কারণ আত্মা দেহকে ভর করে থাকে অথচ তা দেহাতীত।

আত্মার আর একটি বড় প্রমান হলো - মৃত্যুর অব্যবহিত পরেও দেহ ইনট্যক্ট থাকে। তাহলে পরিবর্তনটা কী যাকে আমরা মৃত্যু বলছি? সেটি হলো আত্মার অনুপস্থিতি।

আত্মাকে কেন্দ্র করে মৃত্যু পরবর্তী কোন জীবন আছে কি-না সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। উপরে আমি যে ধরনের ব্যাখ্যা দিলাম তাতে মন বা আত্মার উপস্থিতি অনিবার্য্য।

এখানে মার্ক্সসিস্টরা বলতে পারেন: দেহের অপরিহার্য্য (বস্তুগত) ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে বলেই ‘মৃত্য’ ঘটেছে। অর্থাৎ বিপরীতের ঐক্য নষ্ট হয়েছে। তাই নতুন সিনথেসিস হয়েছে। যেটিকে বলা হয় নিগেশন অব নিগেশন। এখানে মনের বা আত্মার কোন প্রসঙ্গ অবান্তর।

প্রশ্ন হলো: এই ‘বিপরীতের ঐক্য’ কেন নষ্ট হলো? যদি অন্যকোথাও কোন ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারনে এখানে এফেক্ট পড়েছে বলা হয়; তাহলে ‘বেগিং দ্যা কোয়েশ্চন’ হতে বাচার জন্য প্রশ্ন করতে হবে সেখানে ভারসাম্য নষ্ট হলো কেন? এভাবে আপনাকে অন্তহীন পরম্পরাতে গিয়ে ‘অসীম’ নামের এক ফিলোসফিক্যাল গডে বিশ্বাস করতে হবে (অবচেতনে এটলিস্ট); অথবা স্বীকার করতে হবে যে এই বস্তু তথা দেহে এমন একটা কিছু ছিল যার জন্য এটি ফাংশানিং ছিল। যেটির অনুপস্থিতিতে বস্তু তথা দেহটি সজীব থাকা সত্তেও ফল করেছে। যে ঘটনাকে আমরা মৃত্যু বলছি।

দেহের অংগ-প্রত্যংগসমূহ বা সামগ্রিকভাবে দেহ অচল হওয়ার কারনে মৃত্যু ঘটে না। বরং মৃত্যু ঘটার কারনে দেহের অংগ-প্রত্যংগসমূহ অচল হয়ে পড়ে। তাহলে কী সেই ব্যাপার যা বিয়োজিত হওয়ায় ভারসাম্য নষ্ট হয়, দেহ আর কাজ করে না, ধীরে অথবা দ্রুত অচল হয়ে পড়ে?

আমাদের প্রগতিশীল বিজ্ঞানবাদী বন্ধুরা স্বীকার করতে না চাইলেও জীবন-এর জন্য অপরিহার্য এই ‘একটা কিছু’ হলো আত্মা যার সঠিক পরিচয় অজানা। যার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির ফলাফলকে দেখা যায়। যেটি না থাকলে জীবন-এর সব শক্তি ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। সংক্ষেপে আত্মা হলে জীবনীশক্তি। আত্মাকে যদি আমরা স্বীকার করি তাহলে দেহে অবস্থিত কিন্তু দেহ-অতিরিক্ত, কখনো কখনো দেহকে নিয়ন্ত্রণকারী মনকে অস্বীকার করার কোন কারন নাই। কথাটি বিপরীতক্রমেও সম-সত্য।
আমাদের সুশীল বন্ধুদের একটা অংশ আত্মাকে অস্বীকার করার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। তাঁদের ভয় আত্মা বা মনের জানালা দিয়ে না আবার ধর্মের দূষিত বাতাস ঢুকে পরে আর না জানি এতে ইহজাগতিকতার অতি-পবিত্রতা ক্ষুন্ন হয়ে পরে !

এভাবে ভাবুনঃ বস্তু - শক্তি - গুণ - মন - আত্মা

সুধীবৃন্দ, অতি-বিশ্বাসীরা অ-দেখা আত্মাকে যেমন আমাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ও চতুর্পাশ্বস্থ বস্তুনিচয়ের চেয়েও বেশী দেখা মনে করেন, তেমনি আপনারা যারা প্রগতিশীলতা (নিশ্চয়ই মননে)’র দাবী করেন, আপনারা যুক্তির বাহিরে গিয়ে আত্মা বা মনকে অস্বীকার ও বস্তুকে আত্মার সকল বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করে ‘বস্তু’ নামে জপ করা হতে বিরত থাকবেন। অনুরোধ। দেহাতীরিক্ত কিছু যদি থেকে থাকে, তাকে স্বীকার করে নেয়া ভাল। সেজন্য ঈশ্বরবাদী হতে হবে এমন কথা নাই। ধর্মের (আসলে ধর্মবাদীদের) পক্ষে বিবেচিত হবে এজন্য আত্মা বা মনকে যুক্তি-সংগত হওয়া সত্বেও জোর করে অস্বীকার করার চেষ্টা করা ধর্মবাদীদের অজ্ঞতা ও অসহিসনুতার মতোই একটা অগ্রহনযোগ্য ও অনভিপ্রেত চরমপন্থা; বলা যায় এক ধরনের চিন্তা ও মতাদর্শগত সাম্প্রদায়িকতা।

টীকাঃ বিজ্ঞানবাদী - এটি আমার দেয়া। এর সঠিক ইংরেজী কি হবে বুঝতে পারছি না। তবে ধারনাটা এ রকম - বিজ্ঞানবাদী হচ্ছেন তাঁরা যারা বিশ্বাস করেন যে, বিজ্ঞান আমাদেরকে একটি পূর্ণ জীবনাদর্শ দিতে পারে। বিজ্ঞান আমাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দানে সক্ষম। যা পাওয়া যায় নাই তা সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিজ্ঞান-ই হলো একমাত্র পন্থা।

আসলে বিজ্ঞান আমাদেরকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করে। ব্যাপকভাবে। প্রযুক্তি আমাদের কাজে লাগে। সাধারণ মানুষের বিজ্ঞান-সংশ্লিষ্টতা হলো প্রযুক্তি তথা বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রাপ্তি। এর বাইরে বিজ্ঞানের যত তত্ত্ব সবই ফিলোসফিক্যাল। নট ফিলোসফি ইট স্যালফ; বাট দেয়ার ট্রেন্ড ইজ ফিলোসফিক্যাল। আমার এক সহকর্মী সায়েন্টিফিক রিয়্যালিজমের উপরে কাজ করে ড. হয়েছেন। তিনি জোরেশোরে বলেন, বিজ্ঞানকে যতটা অবজেক্টিভ দাবী করা (বিজ্ঞানবাদী’রা) হয়, বিজ্ঞান ততটা অবজেক্টিভ নয়। শুধুমাত্র পরীক্ষণ-লব্ধ ফলাফলই (বৈজ্ঞানিক) জ্ঞান নয়। প্রাপ্ত ফলাফলকে বিশ্লেষণ করে তত্ত্ব নির্মাণ-ই লক্ষ্য যাতে অ-দেখা থাকে অনেকটুকু। এ প্রসঙ্গে পপার, কুন, ফিয়ারাব্যান্ড প্রমুখের লেখা পড়ে দেখা যেতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন