শুক্রবার, ২৩ জুলাই, ২০১০

জ্ঞান ও অন্ধ-বিশ্বাস

আমাদের জ্ঞান কি সীমিত, না অসীম? যদি আমরা অসীম না হই, তাহলে আমাদের জ্ঞান আসলেই কি সত্যিকার অর্থে অসীম হতে পারে? যুক্তিবিদ্যা কী বলে? আমাদের জ্ঞান যদি সসীম হয় তাহলে দর্শনের এই কালো বিড়াল অস্তিত্বহীন নয়। অতএব কোন না কোন দিন এটির গ্রেফতার অবশ্যম্ভাবী, কক্ষ যতেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হোক না কেন। যদি আমরা এভাবে সব জ্ঞান পেয়ে যাই, তাহলে আর কি বাকী থাকে ঘটবার? মৃত্যু। মানব জাতির সমাপ্তি। জ্ঞানের ক্ষেত্রে অতএব, কোনটি? সীমিত, বা অসীম? (অসীম শব্দটির মধ্যে কেমন আধাত্ম-আধাত্ম ফ্লেভার আসে না? উপায়?)
বিশ্বাস হলো প্রমাণ ছাড়া কোন কিছুকে গ্রহন করা। প্রমান চাইতে গেলেই প্রশ্নকে গ্রহন করতে হবে। প্রশ্নকে এক পর্যায়ে থামিয়ে দেয়া ও যুক্তিছাড়াই বিশ্বাসকে জ্ঞান হিসাবে গ্রহন করা বা করতে বাধ্য করা হলো অন্ধ-বিশ্বাস। এসব আমরা জানি। কিন্তু যা আমরা জানি না তা হলো -
জ্ঞানের জগতে যে কোন প্রশ্ন করা যায়, কিন্তু সকল প্রশ্নের প্রমানভিত্তিক উত্তর পাওয়া যায় না। যে সব প্রশ্নের (প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত অর্থে) উত্তর পাওয়া সম্ভব হয় না সে ক্ষেত্রে আমরা যুক্তির (অবশ্য প্রাপ্ত তথ্যভিত্তিক) উপর নির্ভর করে জ্ঞান নির্মাণ করি।
সকল প্রশ্ন করা যায়, বা করতে পারা উচিত, কিন্তু সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না; এবং উপরের আলোচনা অনুযায়ী সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া অনুচিত! (আর কোন প্রশ্ন না থাকলে মৃত্যুছাড়া গত্যন্তর নাই)

কেমন ‘উত্তর’ সঠিক উত্তর? যে ‘উত্তরে’র পরে সে বিষয়ে আর নতুন কোন প্রশ্ন সৃষ্টি হবে না। কৃত প্রশ্নকে উত্তর হিসাবে ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে সেট করা হলো ‘বেগিং দ্যা কোশ্চেন’ বিভ্রান্তি। সুতরাং যে কোন প্রশ্নের সঠিক উত্তর হবে জানার তৃষনা নিবারণকারী। তেমন উত্তর কী পেয়েছেন? যদি পেয়ে থাকেন, ভেবেছেন কি, আপনার প্রাপ্ত উত্তর-এর পেছনে আরো সম্ভাব্য প্রশ্ন এসে পড়ে কি-না? কোন পরবর্তী প্রশ্ন সৃষ্টি করবেনা - এমন উত্তর আদৌ কি পাওয়া সম্ভব বা উচিত?

তাহলে কি ব্যাপারটা এই দাড়ালো যে, সকল প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে বা পাওয়া যাবে - এটি একটা অন্ধ-বিশ্বাস?

আমার মতেঃ প্রশ্নের ব্যাপারে কোন সীমা টানা যাবে না, কিন্তু উত্তর পাওয়ার ব্যাপারে আমাদের সীমাবদ্ধতাকে মানতে হবে। অবশ্য অ-প্রাপ্ত উত্তরের ব্যাপারে আমাদেরকে যথাসম্ভব-প্রমাণ তথা যুক্তির উপর থাকতে হবে।যা হতে পারে ভিন্ন ভিন্ন।

যে সব বিষয়ে প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত প্রমান দেয়া সম্ভব নয়, সেসব বিষয়ে অন্যদের প্রদত্ত/গৃহীত যুক্তি ও তৎনির্ভর জ্ঞানকে শ্রদ্ধা করাই শ্রেয়। নীতি হিসাবে সম্ভবতঃ এটিকে মানবতাবাদ বা জ্ঞানতাত্ত্বিক মানবতাবাদ বলা যেতে পারে।

বুধবার, ২১ জুলাই, ২০১০

বস্তু, শক্তি ও গুণের প্রসঙ্গে আত্মা বা মন সম্পর্কিত ভাবনা

হেগেলের তিনটি সূত্র আছে যেগুলো সাধারনভাবে তাঁর অন্যতম ছাত্র মার্ক্সের নামে প্রচারিত। পরিমাণের গুণে রূপান্তর হলো দ্বিতীয় সূত্র।

বস্তুর ‘নির্দিষ্ট’ পরিমাণ ঘটলে নতুন গুণের আগমন ঘটে। যেমন: একটি ঘড়ির প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ গুলোকে ‘নির্দিষ্ট’ভাবে একত্রিত (সংযোজন অর্থে) করলে নতুন একটাকিছু পাওয়া যায় - সময়।

এই দৃষ্টিতে গুণ বস্তুকে আশ্রয় করে থাকে বটে তবে তা বস্তু-অতিরিক্ত, কিন্তু বস্তু-নিরপেক্ষ বা স্বাধীন নয়। গুন বস্তুর অংশও নয়। ঘড়ির যন্ত্রাংশের মধ্যে সময় বলে কোন পার্টস নাই।

গুণ, বস্তু’র থেকে আলাদা কিনা - এই নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্ক রয়েছে।
মার্কসিস্টরা মনে করেন, মন হলো মস্তিস্কের উপজাত বা বাই-প্রডাক্ট। মন, দেহকে প্রভাবিত করতে পারেনা। দেহই মনকে গঠন করে। এই তত্বের বিপক্ষে অনেক আলোচনা আছে। সেসব এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। মার্ক্স-এর মতানুসারে মন-এর স্ট্যাটাস বস্তু’র গুণের সমতুল্য।

মন নিয়ে প্রাচ্যের চিন্তাধারায় ব্যাপক ভেরিয়েশান আছে। মন ও আত্মা কে আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয়। ইংরেজীতে মাইন্ড, সৌল, স্পিরিট - ইত্যাদি আলাদা শব্দ থাকলেও তত্ত্বীয় আলোচনাতে সব কিছুকে মাইন্ড বা মন হিসাবে ট্রিটমেনট করা হয়।

গূণ-কে যদি বস্তুনির্ভর কিন্তু বস্তুর অতিরিক্ত (যেমন ঘড়ি ও সময়ের ধারনা) হয় তাহলে বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিজ্ঞান ‘প্রাণ’ সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেও আত্মা’র ধারনা নাকচ হয়ে যাবে না। কারণ আত্মা দেহকে ভর করে থাকে অথচ তা দেহাতীত।

আত্মার আর একটি বড় প্রমান হলো - মৃত্যুর অব্যবহিত পরেও দেহ ইনট্যক্ট থাকে। তাহলে পরিবর্তনটা কী যাকে আমরা মৃত্যু বলছি? সেটি হলো আত্মার অনুপস্থিতি।

আত্মাকে কেন্দ্র করে মৃত্যু পরবর্তী কোন জীবন আছে কি-না সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। উপরে আমি যে ধরনের ব্যাখ্যা দিলাম তাতে মন বা আত্মার উপস্থিতি অনিবার্য্য।

এখানে মার্ক্সসিস্টরা বলতে পারেন: দেহের অপরিহার্য্য (বস্তুগত) ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে বলেই ‘মৃত্য’ ঘটেছে। অর্থাৎ বিপরীতের ঐক্য নষ্ট হয়েছে। তাই নতুন সিনথেসিস হয়েছে। যেটিকে বলা হয় নিগেশন অব নিগেশন। এখানে মনের বা আত্মার কোন প্রসঙ্গ অবান্তর।

প্রশ্ন হলো: এই ‘বিপরীতের ঐক্য’ কেন নষ্ট হলো? যদি অন্যকোথাও কোন ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারনে এখানে এফেক্ট পড়েছে বলা হয়; তাহলে ‘বেগিং দ্যা কোয়েশ্চন’ হতে বাচার জন্য প্রশ্ন করতে হবে সেখানে ভারসাম্য নষ্ট হলো কেন? এভাবে আপনাকে অন্তহীন পরম্পরাতে গিয়ে ‘অসীম’ নামের এক ফিলোসফিক্যাল গডে বিশ্বাস করতে হবে (অবচেতনে এটলিস্ট); অথবা স্বীকার করতে হবে যে এই বস্তু তথা দেহে এমন একটা কিছু ছিল যার জন্য এটি ফাংশানিং ছিল। যেটির অনুপস্থিতিতে বস্তু তথা দেহটি সজীব থাকা সত্তেও ফল করেছে। যে ঘটনাকে আমরা মৃত্যু বলছি।

দেহের অংগ-প্রত্যংগসমূহ বা সামগ্রিকভাবে দেহ অচল হওয়ার কারনে মৃত্যু ঘটে না। বরং মৃত্যু ঘটার কারনে দেহের অংগ-প্রত্যংগসমূহ অচল হয়ে পড়ে। তাহলে কী সেই ব্যাপার যা বিয়োজিত হওয়ায় ভারসাম্য নষ্ট হয়, দেহ আর কাজ করে না, ধীরে অথবা দ্রুত অচল হয়ে পড়ে?

আমাদের প্রগতিশীল বিজ্ঞানবাদী বন্ধুরা স্বীকার করতে না চাইলেও জীবন-এর জন্য অপরিহার্য এই ‘একটা কিছু’ হলো আত্মা যার সঠিক পরিচয় অজানা। যার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির ফলাফলকে দেখা যায়। যেটি না থাকলে জীবন-এর সব শক্তি ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। সংক্ষেপে আত্মা হলে জীবনীশক্তি। আত্মাকে যদি আমরা স্বীকার করি তাহলে দেহে অবস্থিত কিন্তু দেহ-অতিরিক্ত, কখনো কখনো দেহকে নিয়ন্ত্রণকারী মনকে অস্বীকার করার কোন কারন নাই। কথাটি বিপরীতক্রমেও সম-সত্য।
আমাদের সুশীল বন্ধুদের একটা অংশ আত্মাকে অস্বীকার করার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। তাঁদের ভয় আত্মা বা মনের জানালা দিয়ে না আবার ধর্মের দূষিত বাতাস ঢুকে পরে আর না জানি এতে ইহজাগতিকতার অতি-পবিত্রতা ক্ষুন্ন হয়ে পরে !

এভাবে ভাবুনঃ বস্তু - শক্তি - গুণ - মন - আত্মা

সুধীবৃন্দ, অতি-বিশ্বাসীরা অ-দেখা আত্মাকে যেমন আমাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ও চতুর্পাশ্বস্থ বস্তুনিচয়ের চেয়েও বেশী দেখা মনে করেন, তেমনি আপনারা যারা প্রগতিশীলতা (নিশ্চয়ই মননে)’র দাবী করেন, আপনারা যুক্তির বাহিরে গিয়ে আত্মা বা মনকে অস্বীকার ও বস্তুকে আত্মার সকল বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করে ‘বস্তু’ নামে জপ করা হতে বিরত থাকবেন। অনুরোধ। দেহাতীরিক্ত কিছু যদি থেকে থাকে, তাকে স্বীকার করে নেয়া ভাল। সেজন্য ঈশ্বরবাদী হতে হবে এমন কথা নাই। ধর্মের (আসলে ধর্মবাদীদের) পক্ষে বিবেচিত হবে এজন্য আত্মা বা মনকে যুক্তি-সংগত হওয়া সত্বেও জোর করে অস্বীকার করার চেষ্টা করা ধর্মবাদীদের অজ্ঞতা ও অসহিসনুতার মতোই একটা অগ্রহনযোগ্য ও অনভিপ্রেত চরমপন্থা; বলা যায় এক ধরনের চিন্তা ও মতাদর্শগত সাম্প্রদায়িকতা।

টীকাঃ বিজ্ঞানবাদী - এটি আমার দেয়া। এর সঠিক ইংরেজী কি হবে বুঝতে পারছি না। তবে ধারনাটা এ রকম - বিজ্ঞানবাদী হচ্ছেন তাঁরা যারা বিশ্বাস করেন যে, বিজ্ঞান আমাদেরকে একটি পূর্ণ জীবনাদর্শ দিতে পারে। বিজ্ঞান আমাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দানে সক্ষম। যা পাওয়া যায় নাই তা সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিজ্ঞান-ই হলো একমাত্র পন্থা।

আসলে বিজ্ঞান আমাদেরকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করে। ব্যাপকভাবে। প্রযুক্তি আমাদের কাজে লাগে। সাধারণ মানুষের বিজ্ঞান-সংশ্লিষ্টতা হলো প্রযুক্তি তথা বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রাপ্তি। এর বাইরে বিজ্ঞানের যত তত্ত্ব সবই ফিলোসফিক্যাল। নট ফিলোসফি ইট স্যালফ; বাট দেয়ার ট্রেন্ড ইজ ফিলোসফিক্যাল। আমার এক সহকর্মী সায়েন্টিফিক রিয়্যালিজমের উপরে কাজ করে ড. হয়েছেন। তিনি জোরেশোরে বলেন, বিজ্ঞানকে যতটা অবজেক্টিভ দাবী করা (বিজ্ঞানবাদী’রা) হয়, বিজ্ঞান ততটা অবজেক্টিভ নয়। শুধুমাত্র পরীক্ষণ-লব্ধ ফলাফলই (বৈজ্ঞানিক) জ্ঞান নয়। প্রাপ্ত ফলাফলকে বিশ্লেষণ করে তত্ত্ব নির্মাণ-ই লক্ষ্য যাতে অ-দেখা থাকে অনেকটুকু। এ প্রসঙ্গে পপার, কুন, ফিয়ারাব্যান্ড প্রমুখের লেখা পড়ে দেখা যেতে পারে।

শনিবার, ১৭ জুলাই, ২০১০

logic আর faith এর পার্থক্য কি সবসময় স্পষ্ট ?

logic আর faith এর পার্থক্য কি সবসময় স্পষ্ট ? যেমন ধরুন বিজ্ঞানের রানী অংক শাস্ত্রকে যার মধ্যে জ্যামিতি হলো সবচেয়ে যুক্তি নির্ভর। জ্যামিতির শুরু হয় কতগুলি স্বতসিদ্ধ দিয়ে যেমন -
বিন্দু - এমন যার দৈর্ঘ ,প্রস্থ কিছুই নেই কেবল অবস্থান আছে। কিন্তু বাস্তবে এমন কোন ‘কিছু’ খুজে পাওয়া যাবেনা যার কেবল অবস্থানা আছে কিন্তু দৈর্ঘ ও প্রস্থ নেই। রেখা এমন যার কেবল দৈর্ঘ আছে প্রস্থ নেই কিন্তু বাস্তবে এমন কোন রেখা নেই যার প্রস্থ নেই। কিন্তু জ্যামিতি পড়তে হলে আমাদের বিশ্বাস করে নিতে হয় বিন্দু আর রেখার সংঙাকে কারন জ্যামিতের সমস্ত logic বিন্দু, রেখা ইত্যাদির উপর প্রতিষ্ঠিত।

এভাবে অনেক ক্ষেত্রে logic এর শুরু হয় বিশ্বাস থেকে (axiomatic or Godly in a sense though axioms are not God in the religious sense, but Godly, i.e., axioms are self-justified.)।

একই ভাবে গনিতে শুন্য ও অসিমের ধারনা কল্পনাপ্রসুত অথচ বিজ্ঞানের সৌধ দাঁড়িয়ে আছে এই কল্পনার উপর বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে

যাক, এই পোস্টের মূল বক্তব্য হলো - বিশ্বাস কে আমরা সাধারণতঃ মনে করি শুধুই বিশ্বাস হিসাবে। হাইপোথিসিস বা প্রকল্প হলো অনুমান যার ভিত্তিতে পরীক্ষণ সম্পন্ন করা হয়। অনেক বছর আগে প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। ফলাফলও ভাল ছিল। বর্তমানে আমি দর্শনের ছাত্র। আমার আগ্রহের বিষয় হলো সমকালীন জ্ঞানতত্ত্ব। আমাদের দেশে হাতেগোণা দু’চার জন এ বিষয়ে উচ্চতর গবেষণা করেছে। আমাদের প্রচলিত অনেক ধারনা জ্ঞানতত্ত্বে এসে পরিবর্তন হয়ে যায়। এ কথা সত্যি যে আমরা কিছু ধরে নিয়ে সেটির ভিত্তিতে অর্থাৎ সেটিকে অভ্রান্ত ধরে নিয়ে অন্যগুলোকে যাচাই করি। তবে যেটিকে আমরা প্রথমেই (যাচাইকরণ ব্যতিরেকে) গ্রহন করি সেটিকে পরবর্তীতে আমরা আবার পূণঃমূল্যায়ন করতে পারি। দুটো প্রধান তত্বকে ঘিরে এই আলোচনা: ফাউন্ডেশানালিজম ও কোহারেন্টিজম।

গণিতের এক সহকর্মী বিন্দু, রেখা, অসীম, কাল্পনিক সংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। সে অনুসারে এই পোষ্ট।

জ্ঞানতত্ত্বে সবই বিশ্বাস, কিছু বিশ্বাস শুধুই বিশ্বাস, কিছু বিশ্বাস যাচাইকৃত ও সত্য। শুধুমাত্র সে সব বিশ্বাসই জ্ঞান পদবাচ্য যা যাচাইকৃত ও সত্য। এ অর্থে আমাদের ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানসমূহও মূলতঃ (ইন্দ্রিয়জ) বিশ্বাস। আমার চোখ এই স্ক্রিণকে সাদা দেখাচ্ছে বলে আমি বলছি এটিকে আমি সাদা দেখছি; বা বলছি, এটি সাদা। এক্ষেত্রে আমি, জ্ঞানের কর্তা ও এই স্ক্রীণ, জ্ঞানের বিষয় - এর মাঝখানে আমার ইন্দ্রিয়জ প্রক্রিয়া, এক্ষেত্রে দৃষ্টি-প্রক্রিয়া, ক্রিয়াশীল। এই সম্পর্কটি মাঝখানে দৃষ্টি-প্রক্রিয়া থাকায় একটি অ-প্রত্যক্ষ সম্পর্ক। প্রত্যক্ষ সম্পর্ক হলো আমার সত্ত্বা বা আমি ও আমার দৃষ্টি-প্রক্রিয়া তথা চোখের মধ্যকার সম্পর্ক। আমি যৌিক্তকভাবে বিশ্বাস করি যে, আমার ইন্দ্রিয়সমূহ আমাকে ‘বাস্তব জগত’ সম্পর্কে ‘সত্যিকারভাবে’ সাক্ষ্য দেয় বা বলে যদিও আমার এ বিশ্বাসের ইন্দ্রিয়-অতিরিক্ত কোন প্রমাণ আমার নাই, স্বজ্ঞা যাকে আমরা সাধারনতঃ বলি, কান্ডজ্ঞান ব্যতিরেকে। এজন্য কমনসেন্স বিরোধী কোনকিছুকে বলা হয় কাউন্টার-ইনট্যুইটিভ। দেখুন, কিভাবে আমরা সেন্স-পারসেপশান হতে ইনট্যুইশানে এসে পড়লাম।

আমার এ কথাগুলো আপনাদের কাছে বিদঘুটে লাগাটা স্বাভাবিক। সেদিন ‘মাপকাঠির মাপ কী’ - এই পোস্টে একজন বলল আমরা ফুটকে ইঞ্চি দিয়ে মাপি, ইঞ্চিকে আরো ছোন এককে মাপি, ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি অত্যন্ত সহজ একটা কথা স্বীকার করতে দ্বীধা করলেন যে, আসলে সব কিছুর মাপ হয়না, অন্ততঃ মাপকাঠির মাপ হয়না। না হওয়াটাই স্বাভাবিক তথা যুক্তি সংগত।

যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীরা বলেছিলেন, অর্থপূর্ণ হতে হলে সব বচনের যাচাইযোগ্যতা তথা পরীক্ষণের উপায় থাকতে হবে। সুতরাং যে কথার কোন বাস্তব পরীক্ষণ সম্ভব নয় তা অর্থপূর্ণ নয়। আর অর্থপূর্ণ না হলে তা সত্য বা মিথ্যা হওয়ার আর কোন অবকাশ থাকেনা। সুতরাং সেটি পরিত্যাজ্য তথা অর্থহীন, আবেগের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। লজিক্যাল পজিটিভিষ্টদের এই দাবীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত চোখা চোখা সব যুক্তির আলোচনাতে ব্লগের পরিবেশ ভারাক্রান্ত না করে বোদ্ধা পাঠকের জন্য শুধু এটুকু বলা যথেষ্ট হবে যে, সবকিছু পরীক্ষণের আওতায় আসতে হবে - এই বাক্যের পরীক্ষণ কি? নাই। এই বাক্যকে মূলনীতি হিসাবে ধরে নিয়েই সব কিছুকে পরীক্ষণের প্রয়াস গ্রহন করা হয়।

বলা হয়, কোন অজানা সংখ্যাকে এক্স ধরে সমীকরণ করলে অজানা সংখ্যাটি সত্যি সত্যি বা বাস্তবিকই এক্স হয়ে যায় না। কথা ঠিক। কিন্তু যদি প্রাপ্ত ফলাফল এটিকে এক্স বলতে আপনাকে বাধ্য করে, অজানা সংখ্যাটিকে যদি ওয়াই ধরা হলে যদি সমীকরণ না মেলে? তথন নিশ্চয়ই আপনি ফলাফলে প্রাপ্ত এক্সকে ওয়াই বলবেন না । অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা প্রদত্ত বা আরোপিত নামকে বদল করে দিতে পারি যদি তা প্রাপ্ত ফলাফলের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়। কোনকিছুর মান যদি হয় ৫ আর এক্স-এর মান ৫ আর ওয়াই-এর মান ২ হয় তাহলে আপনি অজানা সেই কোনকিছুকে কতক্ষণ এক্স আর কতক্ষণ ওয়াই বলতে পারবেন না। এর মোটিভ হচ্ছে বিশ্বাস-এর সাথে যুক্তি ও প্রমাণ -এর সম্পর্ক নির্ণয় করা। বিশ্বাস হতে যুক্তি ও প্রমান অবশ্যই আলাদা বটে কিন্তু বিশ্বাস হলো ভিত্তি ও পরিণতি।

ধারা্টা এমন: প্রাথমিক বিশ্বাস - হতে অনুমান। অনুমানের পক্ষেবিপক্ষে যুক্তি নির্মাণ। যুক্তিরভিত্তিতে - তত্ত্বগত প্রমান-প্রয়াস। প্রমাননির্ভর বিশ্বাস = জ্ঞান। উল্লেখ্য যে, কোন জ্ঞানই নীতিগতভাবে বা স্বয়ং অপরিবর্তনীয় নয়। যে ‘জ্ঞান’এ বিশ্বাস নাই, জ্ঞানতত্ত্ব মোতাবেক তা আদৌ জ্ঞান হিসাবে গণ্য হতে পারে না।

আমরা যা কিছু দেখি তা জ্ঞান নয়, যা কিছুর ভিত্তিতে দেখি ও দেখে যা কিছু মনে করি - জ্ঞান হলো সেসব কিছুর সমষ্টি

মনে করুন একটি বৃত্ত যেটি বিশ্বাসে পূর্ণ। এর মধ্যে আর একটি উপবৃত্ত যা হলো সত্যতায় পূর্ণ। এটির মধ্যে আরও একটি ক্ষুদ্রতর বৃত্ত যা হলো যতটুকু যাচাই করে পাওয়া গেছে তার সমষ্টি। এক্ষণে, অন্তস্থঃ এই দুই উপবৃ্ত্ত নিয়ে যে মুল বৃত্ত তা-ই হলো জ্ঞান। অতএব আপনার বিশ্বাসের পরিধি যতটা বাড়াবেন কমাবেন সে অনুযায়ী আপনার জ্ঞান ভিন্ন ভিন্ন হবে। অথচ সবসময়েই সত্যতা অভিন্ন আর যাচাই প্রায়-অভিন্ন থেকে যায়। এটি হ লো JTB = K - এর ব্যাখ্যা।

রবিবার, ১১ জুলাই, ২০১০

আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক প্রসঙ্গে

প্রসঙ্গঃ একজন ব্লগার লিখলেন - নাস্তিকদের সাথে যুক্তিতে পারা যায় না তবুও তিনি আস্তিক তথা বিশ্বাসী

যদি নাস্তিকদের সাথে যুক্তিতে না পারেন, তাহলে আস্তিক হলেন কিভাবে? অর্থাৎ, নাস্তিকতাই যদি যুক্তি সংগত হয় তাহলে আপনার ‘বিশ্বাসের’ কি মূল্য? আমি যতটুকু জানি, ইসলামী মতাদর্শ অনুযায়ী আল্লাহও চান না মানুষ না বুঝে, যুক্তিসংগত হিসাবে গ্রহন করা ছাড়াই, ঈমান আনুক ইসলামী মতাদর্শ অনুযায়ী ঈমান বা বিশ্বাসের মধ্যে অন্তরের উপলব্ধি, মৌখিক দাবী ও কর্মগত সাদৃশ্য এই তিন-এর সমন্বয় বা অন্তর্ভূক্তি অপরিহার্য্য

তাই আমি মনে করি, নাস্তিকদের সাথে কেউ যদি যুক্তিতে কুলিয়ে উঠতে না পারেন, তাহলে তাঁর আস্তিক থাকার কোন কারন নাই জ্ঞানবিহীন বিশ্বাস অর্থহীন, অসম্ভব

স্মর্তব্য যে, নাস্তিকতাকে খন্ডন করা আস্তিক হওয়ার অপরিহার্য্য শর্ত নয় আস্তিকতার যুক্তি আছে - কেবলমাত্র এতটুকুই যথেষ্ট

আস্তিকতাকে খন্ডন করা প্রচেষ্টা যেমন নাস্তিকদের একটা শ্রেণীগত বিভ্রান্তি বা ক্যাটাগরী মিস্টেক তেমনি নাস্তিকতাকে খন্ডন করার জন্য আস্তিকদের প্রচেষ্টাও সুস্পষ্টভাবে শ্রেণীগত বিভ্রান্তি বটে

কারন -

‘প্রমান’ দিয়ে ‘বিশ্বাস’ হয় না ‘বিশ্বাসে’র ভিত্তি হলো ‘যুক্তি’ এবং ‘যুক্তি’ই হলো ‘জ্ঞানে’র ভিত্তি, উপাদান ও মৌলিক কাঠামো

তাই -

অনুমান ছাড়া শুধুমাত্র ‘প্রমান’ দিয়ে ‘জ্ঞান’ হয় না ‘প্রমান’ লাগে, যেটি হলো তথ্য যা ‘জ্ঞানে’র একক যেমন দালানের জন্য ইট-এর খন্ড গুলোকে আমরা দালানের একক বলতে পারি তথ্য ও জ্ঞানের পার্থক্য সম্পর্কে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে তথ্য ছাড়া জ্ঞান হয়না তাই বলে সব তথ্য জ্ঞান নয় তথ্যের ‘নির্দিষ্ট সমাহার’ হলো্ জ্ঞান অনুমান-ই হলো এই ‘নির্দিষ্ট সমাহার’ শর্ত হলো সংশ্লিষ্ট অনুমান-কে হতে হবে যুক্তি-সংগত

সকল জ্ঞানই মূলতঃ বিশ্বাস (বা অনুমান) কিন্তু সকল বিশ্বাস জ্ঞান নয় জ্ঞান হলো যুক্তিসংগত সত্য বিশ্বাস

অতএব, অ-যৌক্তিক বিশ্বাস-ই হলো অন্ধ-বিশ্বাস কেউ যদি স্বীকার করেন যে, নাস্তিকদের যুক্তি অধিকতর গ্রহনযোগ্য, তাহলে তিনি একজন নাস্তিক সামাজিক কারনে তিনি নিজেকে নাস্তিক পরিচয় না দিলেও

আমাদের সমাজে নাস্তিকরা সাধারনতঃ নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে চান না মজার ব্যাপার হলো অনেকেই জানেন না যে, তিনি নাস্তিক নাস্তিকতাকে এখানে গালি হিসাবে ব্যবহার করা হয় জন্মগতভাবে কেউ আস্তিক বা নাস্তিক হন না আস্তিকতা বলুন, নাস্তিকতা বলুন - এগুলো অর্জন করতে হয়

আমাদের দেশে সবাই বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী আস্তিকতো বটেই, এমনকি হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টানরাও ‘মুসলিম’! কারন, ‘রাষ্ট্রধর্ম’(!) হলো ইসলাম কী বিচিত্র ! ইসলাম অন্ততঃ ‘রাষ্ট্রধর্ম’ হওয়ার কোন ব্যাপার নয় অবুঝ (জন্মগতভাবে) মুসলিমরাই ইসলামের বড় সমস্যা

আস্তিক হোন আর নাস্তিক হোন - জেনে-বুঝে হোন হঠকারী (এক্সট্রিম) হবেন না যা কিছুর ‘যু্ক্তি নাই’ তা পরিত্যাগ করুন যুক্তিবাদী হোন, তাহলেই সত্যিকারের বিশ্বাসী হতে পারবেন (ভালভাবে) [link|http://www.somewhereinblog.net/blog/mhq/29183019|বাঁচতে হলে আমাদেরকে সত্যিকারের বিশ্বাসী হতে হবে বিশ্বাসের বিষয় যা-ই হোক না কেন]


বিঃ দ্রঃ যারা বিপরীত মত-কে গালি দানে ধন্য হোন, তাঁরা দয়া করে মন্তব্য দানে বিরত থাকবেন