সার-সংক্ষেপঃ ক. নারীরা পুরুষের পুরুষের অর্ধেক সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকেন – এটি ভুল ধারনা। নারীরা কখনো কম, কখনো বেশী ও কখনো সমান পেয়ে থাকেন। কোন কোন ক্ষেত্রে শুধু নারীরাই পেয়ে থাকেন। যেমন- (১) ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের কেবলমাত্র ৪টি ক্ষেত্রে নারী সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষের অর্ধেক পান। (২) ৪টি ক্ষেত্রে সমপর্যায়ের আত্মীয় হওয়া সত্বেও পুরুষ পুরোপুরি বঞ্চিত হন। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট নারী পান, পুরুষ কিছুই পাননা। (৩) ১২টি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষের তুলনায় নারী অধিক পরিমাণে সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকেন। (৪) ১০ অবস্থায় নারী সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষের সমান পেয়ে থাকেন।
খ. উত্তরাধিকার সূত্রে পুরুষের তুলনায় সর্বমোট সম্পত্তি কম পেলেও উপার্জন ও সাংসারিক ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব হতে মুক্ত থাকায় নারীদের উদ্বৃত্ত সম্পদের পরিমাণ পর্যাপ্ত হওয়ার কথা।
গ. মৃত সন্তানের পরিবারের সুরক্ষার জন্য মোট সম্পত্তির অনূর্ধ এক-তৃতীয়াংশ ওছিয়ত করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব, যা নিশ্চিত করাটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
ঘ. ইসলামী রাষ্ট্র মানেই সবার জন্য ইসলামী উত্তরাধিকার আইন – এমনটি নয়। ইসলামী উত্তরাধিকার আইন শুধুমাত্র তাঁদের জন্য প্রযোজ্য যারা এটিকে মানতে চাইবে (যেমন মুসলিমগণ)।
ঙ. ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের মূল ভিত্তি হলো নারী-পুরুষের সম্পর্ক নির্ভর পরিবার ব্যবস্থা যার মূলনীতি হলো পারিবারিক দায়িত্বনির্ভর অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা।
চ. নারী-পুরুষের মানবিক মর্যাদা অভিন্ন হওয়া সত্বেও প্রাকৃতিকভাবে নারী ও পুরুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা ভিন্নতর। এই দৃষ্টিতে ইসলামী উত্তরাধিকার আইন প্রাকৃতিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ছ. নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক ভিন্নতাকে পূঁজি করে আমাদের সমাজে নারীদের উপর চলমান সকল অ-মানবিক বৈষম্য রোধে আমাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করা উচিত।
ভূমিকাঃ ক. ইসলামী উত্তরাধিকার আইনঃ একটি পর্যালোচনা – এই প্রবন্ধটিতে সকল আলোচনা ইসলামী উত্তরাধিকার আইনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। তাই, যারা এটিকে গ্রহনযোগ্য মনে করবেন না (যেমন অমুসলিমরা) তাঁদের পূর্ণ অধিকার থাকবে নিজস্ব পারিবারিক আইন অনুযায়ী জীবন যাপনের।
খ. ইসলামের উত্তরাধিকার আইন ইসলামের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি। ইসলামী সমাজ পরিবার কেন্দ্রিক। পরিবার বলতে নারী ও পুরুষের মধ্যকার সম্পর্কনির্ভর চিরায়ত পরিবার ব্যবস্থাকেই বোঝানো হয়েছে।
গ. ইসলামী উত্তরাধিকার আইন ‘ইসলাম অনুযায়ী ঠিক আছে’ – এটি দেখানো এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। ইসলামী উত্তরাধিকার আইন অগ্রহনযোগ্য – এটি দেখানোও এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়।
ঘ. তাই, ইসলামের মূলনীতির সাথে এ বিষয়টি সুসামঞ্জস্য কিনা এটি দেখার সাথে সাথে আমরা যাচাই করার চেষ্টা করবো - একটি প্রস্তাবণা হিসাবে ইসলামের উত্তরাধিকার আইন যুক্তিসংগত কিনা।
ঙ. পুরো আলোচনাটিকে প্রশ্ন-উত্তর ধরনে সাজানো হয়েছে।
প্রশ্ন১- আমি যখন আমার ছেলে-মেয়েকে লালনপালনের সময় কোন পার্থক্য করিনা, তখন আমার মেয়েটি কেন উত্তরাধিকার প্রাপ্তির সময় তাঁর ভাইয়ের অর্ধেক পাবে?
উত্তরঃ আপনার/আমার কন্যা শিশুটি বড় হয়ে মা হবেন, ধারনা করা যায়, তিনি একটি পরিবারে মাতৃত্বের দায়িত্বপালন করবেন। একটি পরিবারে নারী-পুরুষ উভয়ে, এমনকি সন্তানেরাও উপার্জন করতে পারে। তৎসত্বেও, উপার্জনের দায়িত্ব এককভাবে শুধুমাত্র পিতার। কন্যা সন্তানটির তাবৎ ব্যয়নির্বাহের দায়িত্ব কখনোই তাঁর উপরে বর্তায় না। তাই, উত্তরাধিকার বন্টনের ক্ষেত্রেও তাঁকে কোন কোন ক্ষেত্রে কম দেয়া হয়েছে।
প্রশ্ন২- পরিবার প্রতিপালনে অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব হতে পুরোপুরি অব্যাহতি দেয়ার পর কন্যা সন্তানদেরকে আদৌ সম্পদের অংশীদার করা হলো কেন?
উত্তরঃ ব্যক্তিত্ব ও মানবীয় মর্যাদা নিশ্চিতকরণের অন্যতম অপরিহার্য শর্ত হলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ন্যূনতম অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা (সাপোর্ট) থাকা। নারীদের ক্ষেত্রে মোহরানা (ম্যরেজ গিফট) ও মিরাছ (স্বজন ও আত্মীয়দের সম্পদ-সম্পত্তিতে প্রাপ্যতা) –এর মাধ্যমে পৃথিবীর ইতিহাসে ইসলামী মতাদর্শই প্রথম নারীদের এই একান্ত প্রয়োজনীয় সামাজিক তথা মানবিক মর্যাদা দিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে আজ অবধি এর কোন বিকল্প নাই।
প্রশ্ন৩- নারীদেরকে সম্পত্তির অর্ধেক দেয়ার নিয়ম কেন?
উত্তরঃ সর্বক্ষেত্রে কম দেয়া হচ্ছে – এই বদ্ধমূল ধারনাটা ভুল। কেবলমাত্র ৪টি ক্ষেত্রে নারী সংশ্লিষ্ট পুরুষের অর্ধেক পেয়ে থাকেন। যেমন:
১(১). মৃতের ছেলে ও মেয়ে সন্তান জীবিত থাকলে অন্য কোন স্বজন উত্তরাধিকারী হিসাবে বিবেচিত হবেন না। তখন মৃতের সম্পত্তি পুত্র ও কন্যাদের মধ্যে মৃতের মোট সম্পত্তির ৩ভাগের ২ভাগ ছেলে সন্তান পাবেন ও ১ভাগ মেয়ে সন্তান পাবেন।
১(২). মৃতের শুধুমাত্র পিতা ও মাতা জীবিত থাকলে মৃতের সম্পত্তির ৩ভাগের ২ভাগ পিতা পাবেন। ১ভাগ মাতা পাবেন।
১(৩). মৃতের ১জন ভাই ও ১জন বোন থাকলে তাঁর রেখে যাওয়া সম্পত্তির ভাই পাবেন ৩ভাগের ২ভাগ, বোন পাবেন ১ভাগ।
১(৪). অনুরূপভাবে মৃতের জীবিত আত্মীয়দের মধ্যে শুধুমাত্র বৈমাত্রেয় ভাই-বোন থাকলে মরহুমের রেখে যাওয়া সম্পত্তির ৩ভাগের মধ্যে বৈমাত্রেয় ভাই ২ভাগ ও বৈমাত্রেয় বোন ১ভাগ পরিমাণে প্রাপ্য হবেন।
নারীদের সমপর্যায়ের পুরুষের তুলনায় কখনো বেশী দেয়া হয়, কখনো সমান দেয়া হয়, কখনো কম দেয়া হয়। সর্বোপরি উত্তরাধিকার হিসাবে সম্পত্তি কম পেলেও অর্থনৈতিক দায়মুক্ত থাকার কারনে নারীদের মোট উদ্বৃত্ত সম্পদ (আসলে পুরোটাই উদ্বৃত্ত) তাঁদের সমপর্যায়ের পুরুষের তুলনায় অবশ্যই বেশী হওয়ার কথা। আমাদের সমাজে এতদসংশ্লিষ্ট ইসলামী আইনের প্রয়োগ ও সুষম প্রয়োগ না থাকার বিষয়টা নিতান্তই বেদনাদায়ক।
ইসলামের আইন ও এর নীতি-আদর্শভিত্তিক এই তাত্ত্বিক হিসাব এবং আমাদের বাংলাদেশে এর বিপরীত করুন সামাজিক বাস্তবতার বিষয়টা অতি-স্পষ্ট হওয়ায় এ বিষয়ে অধিকতর আলোচনা নিস্প্রয়োজন মনে করছি।
প্রশ্ন৪- নারীরা পুরুষের বেশী পান - এ’রকম কোন প্রমাণ কি আছে?
উত্তরঃ সুরা নিসার ৭,৮,১১ ইত্যাদি আয়াতে উত্তরাধিকার আইনের মূলনীতি বর্ণিত আছে। সে অনুসারে নীচের হিসাবটা দেখুন:
২(৫) মৃতের স্বামী, পিতা, মাতা, কন্যা ও ছেলের কন্যা বেঁচে থাকলে মৃতের সম্পত্তিকে ১৫ভাগ করা হবে। এক্ষেত্রে স্বামী পাবেন ৩ভাগ, পিতা পাবেন ২ভাগ, মাতা পাবেন ২ভাগ, কন্যা পাবেন ৬ভাগ, ছেলের কন্যা পাবেন ২ভাগ।
এক্ষেত্রে মৃতের ছেলের ঘরের কন্যা না থেকে পুত্র থাকলে সেই পুত্র কিছুই পাবে না। হিসাবটা নিম্নরূপ –
মৃতের সম্পত্তির ১৩ভাগ করে =
স্বামী ৩ভাগ + পিতা ২ভাগ + মাতা ২ভাগ + কন্যা ৬ভাগ + ছেলের ছেলে ০ভাগ।
২(৬) মৃতের জীবিত স্বজনদের মধ্যে স্বামী, সহোদর বোন ও বৈমাত্রেয় বোন থাকলে মৃতের সম্পত্তিকে ১৫ভাগ করে স্বামীকে দিতে হবে ৬ভাগ, সহোদর বোনকে দিতে হবে ৬ভাগ ও বৈমাত্রেয় বোনকে দিতে হবে ৩ভাগ।
অথচ, মৃতের বৈমাত্রেয় বোন না থেকে বৈমাত্রেয় ভাই থাকলে, তিনি সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষ হওয়া সত্বেও কিছু পাবেন না। তখন হিসাবটা হবে নিম্নরূপ: মৃতের সম্পত্তি ২ভাগ = স্বামী ১ভাগ + সহোদর বোন ১ভাগ + বৈমাত্রেয় ভাই ০ভাগ। বাদ পড়া অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মতো বৈমাত্রেয় ভাইও তাঁর বৈমাত্রেয় বোনের রেখে যাওয়া সম্পত্তির কোন অংশের উত্তরাধিকারী হিসাবে বিবেচিত হবেন না।
২(৭) মৃতের স্বজনদের মধ্যে শুধুমাত্র পিতা, দাদা ও দাদী বেঁচে থাকলে মৃতের সম্পত্তির ৬ভাগের ৫ভাগ পাবেন পিতা আর দাদী পাবেন ১ভাগ। দাদা কিছু পাবেন না।
২(৮) শুধুমাত্র নানা ও নানী বেঁচে থাকলে মৃতের সম্পত্তির পুরোটাই নানী পাবেন। নানা কিছু পাবেন না।
প্রশ্ন৫- উত্তরাধিকার বন্টনের নিয়ম (তথা এই ‘বৈষম্যে’র (?) হেতু) কী?
উত্তরঃ ইসলামের উত্তরাধিকার আইনে ১২জনের অংশ নির্ধারিত। এদের ৮জনই নারী (মা, মেয়ে, স্ত্রী, ছেলের মেয়ে, সহোদরা বোন, বৈমাত্রেয় বোন, বৈপিত্রেয় বোন, দাদী, নানী)। নির্ধারিত উত্তরাধিকার পাবে এমন পুরুষের সংখ্যা ৪জন (বাবা, স্বামী, দাদা ও মা-এর দিক থেকে ভাই)। এই ৪জন পুরুষ ছাড়া সকল পুরুষ উত্তরাধিকারী ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে ‘আসাবা’ বা অবশিষ্টাংশ ভোগী। ‘যাবিল ফুরুজ’ হিসাবে নির্ধারিত অংশসমূহ বন্টিত হওয়ার পরে ‘আসাবা’রা (অধিকাংশই পুরুষ) পেতেও পারেন নাও পেতে পারেন। যেমনটি উপরের ৪টি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষগণকে ‘বঞ্চিত’ করা হয়েছে এবং সমপর্যায়ের নারীকে প্রাধান্য বা পুরোটাই দেয়ার বিধান দেয়া হয়েছে।
প্রশ্ন৬- নারীরা সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের পুরুষের অধিক পাবেন কখন?
উত্তরঃ ৩(৮) মৃতের স্বামী, ১কন্যা ও চাচার উপস্থিতিতে মৃতের সম্পত্তি ৪ভাগ করা হবে। এক্ষেত্রে স্বামী ১ভাগ, চাচা ১ভাগ ও কন্যা ২ভাগ পাবেন।
৩(৯) উপরের হিসাবে যদি কন্যা ২জন হন, তাহলে মৃতের সম্পত্তি ১২ভাগ করা হবে। সেক্ষেত্রে কন্যারা ৪ভাগ করে মোট ৮ভাগ পাবেন, স্বামী পাবেন ৩ভাগ ও চাচা পাবেন ১ভাগ।
৩(১০) মৃতের ১কন্যা ও ও ২ভাই থাকলে মৃতের সম্পত্তির ৪ভাগের ২ভাগ পাবেন কন্যা আর ভাইয়েরা পাবেন ৪ভাগের ১ভাগ করে।
৩(১১) মৃতের স্বামী, ২জন সহোদরা বোন ও মা থাকলে মৃতের সম্পত্তি ৮ভাগ করে এর ৩ভাগ পাবেন স্বামী, ২বোন পাবেন ৪ভাগ ও মা পাবেন ১ভাগ। অথচ, মৃতের স্বামী ও মা-এর উপস্থিতিতে ২ বোনের পরিবর্তে ২ভাই থাকলে স্বামী পাবেন ৬ভাগের ৩ভাগ, মা পাবেন ১ভাগ ও ২জন ভাই-এর প্রত্যেকে পাবেন ৬ভাগের ১ভাগ করে।
৩(১২) অনুরূপভাবে মৃতের বৈমাত্রেয় ২ভাই থাকলে যা পেতেন, তদস্থয়ে বৈমাত্রেয় ২বোন থাকলে দ্বিগুণ পাবেন।
[হিসাব: স্বামী ৩ভাগ+বৈমাত্রেয় ২বোন ৪ভাগ+ মা ১ভাগ = ৬ভাগ। # স্বামী ৩ভাগ+বৈমাত্রেয় ২ভাই ২ভাগ+ মা ১ভাগ = ৬ভাগ।]
৩(১৩) মৃতের স্বামী, পিতা, মাতা ও মেয়ে জীবিত থাকলে মৃতের মেয়ে সন্তান যা পাবেন মেয়ে না থেকে ছেলে থাকলে এর অনেক কম পাবেন।
[স্বামী ৩ভাগ + পিতা ২ভাগ + মাতা ২ভাগ + মেয়ে ৬ ভাগ = ১৩ভাগ।
স্বামী ৩ভাগ + পিতা ১ভাগ + মাত ১ভাগ + ছেলে ১ভাগ = ৬ ভাগ।]
৩(১৪) মৃতের স্বামী, মা ও ১জন সহোদরা বোন থাকলে মৃতের সম্পত্তির বোন যা পাবেন, বোন না থেকে যদি ১জন সহোদর ভাই থাকতেন তাহলে তিনি বোন-এর প্রাপ্য অংশের চেয়ে কম পাবেন।
[স্বামী ৩ভাগ + মা ১ভাগ + সহোদরা বোন ৩ভাগ = ৭ভাগ # স্বামী ৩ভাগ + মা ১ভাগ + সহোদর ভাই ২ভাগ = ৬ভাগ]
প্রশ্ন৭- উপরের উদাহরণগুলোতে সংশ্লিষ্ট পুরুষ সম-পর্যায়ের নয়। সংশ্লিষ্ট নারী/নারীরা রক্তের সম্পর্কের দিক থেকে মৃতের অধিকতর কাছের স্বজন। তাই, তাঁরা বেশী পাওয়াটা স্বাভাবিক। এমনকোন কোন উদাহরণ আছে কি যাতে রক্তের দিক থেকে সংশ্লিষ্ট সমপর্যায়ের নারী-পুরুষের মধ্যে উত্তরাধিকার বন্টনের সময় নারীরা বেশী পান?
উত্তরঃ নিম্নের উদাহরণ থেকে দেখা যাবে রক্তের সম্পর্কের দিক থেকে সমপর্যায়ের হওয়া সত্বেও কোন কোন পরিস্থিতিতে নারীরা পুরুষের বেশী পান –
৪(১৫) স্বামী, পিতা, মাতা ও ২জন কন্যার বদলে কোন মুসলিম নারী স্বামী, পিতা, মাতা ও ২জন পুত্র রেখে মারা গেলে পুত্রদের চেয়ে কন্যারা বেশী পরিমাণে সম্পত্তি পাবেন।
[স্বামী ৩ভাগ + পিতা ২ভাগ + মাতা ২ভাগ + কন্যারা ৮ভাগ = ১৫ভাগ। #
স্বামী ১৫ভাগ + পিতা ১০ভাগ + মাতা ১০ভাগ + পুত্রদ্বয় ২৫ ভাগ = ৬০ভাগ।]
৪(১৬) শুধুমাত্র পিতা, মাতা ও স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় মৃতের সম্পত্তিতে মা, তাঁর বাবার দ্বিগুণ পাবেন।
[পিতা ১ভাগ + মাতা ২ভাগ + স্বামী ৩ভাগ = ৬ভাগ]
কখনো কখনো সংশ্লিষ্ট নারী রক্তের সম্পর্কের দিক হতে দূরের হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে বেশী পরিমাণে উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হন। যেমনঃ
৫(১৭) ওয়ারিস যদি হন স্ত্রী, মা, বৈপিত্রেয় ২জন বোন এবং ২জন সহোদর ভাই তখন দূরের আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও বৈপিত্রেয় ২জন বোন, মৃতের আপন ২জন ভাইয়ের চেয়ে বেশী পাবেন।
[স্ত্রী ৩ভাগ + মা ৩ভাগ + সহোদর ২ভাই ১ভাগ করে মোট ২ভাগ + বৈপিত্রেয় ২বোন ২ভাগ করে মোট ৪ভাগ = ১২ভাগ।]
৫(১৮) অনুরূপভাবে ওয়ারিস যদি হন স্বামী, ২জন সহোদর ভাই ও ২জন বৈপিত্রেয় বোন তখনও বৈপিত্রেয় বোনেরা সহোদর ভাইয়ের চেয়ে মৃতের সম্পত্তি পাবেন কম (অর্ধেক)।
[স্বামী ৬ভাগ + সহোদর ২জন ভাই ১ভাগ করে মোট ২ভাগ + বৈপিত্রেয় ২জন বোন ২ভাগ করে মোট ৪ভাগ = ১২ভাগ।]
৫(১৯) স্বামী, মা, ২জন সহোদর ভাই ও ১জন বৈপিত্রেয় বোন থাকা অবস্থায় মৃতের ভাইয়ের তূলনায় বৈপিত্রেয় বোন দূরের আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারনে মৃতের সহোদর ভাইদ্বয়ের দ্বিগুণ পরিমাণ সম্পত্তির অধিকারী হবেন।
[স্বামী ৬ভাগ + মা ২ভাগ + সহোদর ২জন ভাই ১ভাগ করে মোট ২ভাগ + বৈপিত্রেয় ১জন বোন ২ভাগ = ১২ভাগ।]
প্রশ্ন৮- কোন্ কোন্ অবস্থায় নারীরা পুরুষের সমান মিরাছ পান?
উত্তরঃ ১০ অবস্থায় নারীরা পুরুষের সমান মিরাছ পেয়ে থাকেন-
৬(২০) পিতা-মাতা সমান পান ছেলের ঘরে নাতি থাকলে।
[পিতা ১ভাগ + মাতা ১ভাগ + নাতি ৪ভাগ = ৬ভাগ।]
৬(২১) মৃতের শুধুমাত্র বৈপিত্রেয় ২ ভাই-বোন থাকলে, তাঁরা সমান পাবেন।
[বৈপিত্রেয় ভাই ১ভাগ + বৈপিত্রেয় বোন ১ভাগ = ২ ভাগ।]
৬(২২) মৃতের ওয়ারিস হিসাবে অন্যান্যদের অনুপস্থিতিতে শুধুমাত্র বৈমাত্রেয় ভাই-বোন থাকলে সব ধরনের বোনেরা (সহোদরা, বৈপিত্রেয় ও বৈমাত্রিয়) বৈপিত্রেয় ভাইয়ের সমান পাবেন। যেমন-
[বৈমাত্রেয় ভাই ২ভাগ + বৈপিত্রেয় ভাই ১ভাগ + বৈমাত্রেয় বোন ১ভাগ + সহোদরা ২জন বোন ১ভাগ করে ২ভাগ = ৬ভাগ।]
৬(২৩) মৃতের একমাত্র কন্যা ও আপন একজন চাচার উপস্থিতিতে উভয়ে অর্ধেক পরিমাণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন।
৬(২৪) মৃতের ছেলের ঘরে ছেলে থাকলে নানী, পিতার সমান পাবেন। এক্ষেত্রে আমরা বুঝতে পারছি, এরা ৩জন ছাড়া মৃতের ওয়ারিস-যোগ্য আর কোন স্বজন নাই। [ছেলের ঘরে নাতি ৪ভাগ + পিতা ১ভাগ + নানী ১ভাগ = ৬ভাগ।]
৬(২৫) মাতা, ২জন বৈপিত্রেয় বোন, স্বামী ও ১জন সহোদর ভাই যখন কোন মৃতের ওয়ারিস হন তখন মৃতের মাতা তদীয় সহোদর ভাইয়ের সমান অংশ পাবেন। [স্বামী ৩ভাগ + বৈপিত্রেয় বোন ২জন ১ভাগ + মাতা ১ভাগ + ভাই ১ভাগ = ৬ভাগ।]
৬(২৬) সহোদর বোন স্বামীর সাথে ওয়ারিস হলে সহোদর ভাইয়ের সমান অংশ পাবে।
[স্বামী ১ভাগ + ভাই ১ভাগ + বোন ১ভাগ = ৩ভাগ।]
৬(২৭) মৃতের স্বামী ও মাতার উপস্থিতিতে অন্য কেউ না থাকলে বৈপিত্রেয় বোন সহোদর ভাইয়ের সমান পাবেন।
[স্বামী ৩ভাগ + মাতা ১ভাগ + সহোদর ভাই ১ভাগ + বৈপিত্রেয় বোন ১ভাগ = ৬ভা্গ।]
৬(২৮) মৃতের ওয়ারিস হিসাবে মেয়ের ছেলে, মেয়ের মেয়ে, মামা ও খালা ছাড়া ওয়ারিস-যোগ্য কেউ জীবিত না থাকলে সবাই সমান অংশ পাবেন। [মেয়ের ছেলে ১ভাগ + মেয়ের মেয়ে ১ভাগ + মামা ১ভাগ + খালা ১ভাগ = ৪ভাগ।]
প্রশ্ন৯- দাদার বর্তমানে পিতার মৃত্যু হলে তাঁর সন্তানেরা দাদার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হন। এটি কি অন্যায় নয়?
উত্তরঃ কেউ জীবিত থাকা অবস্থায় অন্যরা তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী কিভাবে হবেন? এক্ষেত্রে ছেলের পরিবারের সুরক্ষার জন্য দাদা তাঁর সম্পত্তির এমনকি এক তৃতীয়াংশও ওছিয়ত করতে পারেন যা তাঁদের সম্ভাব্য প্রাপ্য ওয়ারিসী হিস্যারও বেশী হতে পারে।
প্রশ্ন১০- বাবার মৃত্যুর পর দাদা যদি তাঁর মৃত পুত্রের পরিবারকে তদীয় সম্পত্তির অংশবিশেষ ওছিয়ত না করেন বা না করতে পারেন, তাহলে?
উত্তরঃ রাষ্ট্র এই অছি’র ভূমিকা নিতে পারে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র অছিয়্যতকে বাধ্যতামূলক করতে পারে বা করা হয়েছে ধরে নিতে পারে। ইসলামী রাষ্ট্র তথা কল্যাণ রাষ্ট্র না থাকাতে এ সমস্যা আমাদের দেশে প্রকট। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা থাকলে ওয়ারিস হতে বা যে কোন প্রকারে বঞ্চিতদের দায়িত্ব গ্রহনে সরকার বাধ্য।
প্রশ্ন১১- ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরাও ইসলামী উত্তরাধিকারী আইন মানতে বাধ্য?
উত্তরঃ না, ইসলামী উত্তরাধিকার আইন শুধুমাত্র তাঁদের জন্য প্রযোজ্য যারা এটিকে সঠিক মনে করবে। যেমন, মুসলিমরা।
প্রশ্ন১২- এই উত্তরাধিকার আইন বলবৎ করা ছাড়া ইসলামী রাষ্ট্র হতে পারে?
উত্তরঃ ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাথমিক পর্যায়ে অছিয়ত বা প্রচলিত দেশীয় পদ্ধতি অনুযায়ী উত্তরাধিকার বন্টিত হতে পারে। যেমন তৃতীয় হিজরীর শেষের দিকে সংঘটিত ওহুদ যুদ্ধের আগ পর্যন্ত মদীনার ইসলামী রাষ্ট্র পরবর্তীকালে বলবৎকৃত উত্তরাধিকার আইন ব্যতিরেকে চলছিল। তখন মৃত্যুকালে অছিয়ত করা মুসলিমদের জন্য অত্যাব্যশক ছিল যা মিরাছী আইনের উপস্থিতিতে ঐচ্ছিক হিসাবে কার্যকর রয়েছে।
প্রশ্ন১৩- ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের মূলনীতি কী?
উত্তরঃ ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের মূলনীতির অন্যতম হচ্ছে-
ক. মৃত ব্যক্তির সাথে ওয়ারিসের নৈকট্য।
খ. নতুন প্রজন্ম বা বংশধর প্রবীণদের তুলনায় বেশি পাবে।
গ. সংশ্লিষ্টের সামাজিক দায়ভার ও আর্থিক প্রয়োজনীয়তা।
পর্যালোচনা / মন্তব্য –
১. উত্তরাধিকার আইনসহ ইসলামী সকল আইন ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত। ইসলামী রাষ্ট্র তথা সমাজ নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক সম্পর্ক-নির্ভর একটি প্রতিষ্ঠান ও বিবাহ নামক একটি প্রথার উপর নির্ভরশীল।
২. যাঁরা প্রচলিত পরিবার নামক এই মূল সামাজিক প্রতিষ্ঠানের স্থলে ‘লিভ টুগেদার’কে স্থান দিতে চান, তাঁদের গ্রহনযোগ্য যুক্তি দিয়ে দেখাতে হবে – গে এবং লেসবিয়ান ‘বিয়ে’ আইনসিদ্ধ হলে প্রাণী কিম্বা উপযোগী কৃত্রিম ব্যবস্থার সাথে ‘ভার্চূয়াল বিয়ে’ আইনসম্মত হবে না কেন? যদি হয়, তাহলে সে ধরনের মানবীয় রূচি বিরোধী কার্যক্রমকে বিয়ে বলা হবে কেন?
৩. বিয়ে হচ্ছে নর-নারী সম্পর্কের সামাজিক স্বীকৃতি ও এ সম্পর্ককে সম্ভাব্য দায়বদ্ধতার সীমা স্থিত করা। এটিকে যদি আমরা মানি, প্রচলিত পরিবার ব্যবস্থাকে আমাদের মানতে হবে। তা যদি মানি, তাহলে অপরাপর যে কোন প্রতিষ্ঠানের মতোই এর একটি স্তর-বিন্যাস থাকা বাঞ্ছনীয়।
৪. ইসলামী মতাদর্শ অনুযায়ী মানুষ হিসাবে নারী পুরুষ সমান। যেসব ক্ষেত্রে নারীদেরকে দায়িত্বমুক্ত রাখা হয়েছে তার উদ্দেশ্য হলো প্রকৃতির অনুরূপ কর্মবিন্যাস নিশ্চিতকরণ। অধিকারের সাথে দায়িত্ব সম্পর্কিত। বাহিরের ভারী কাজগুলো পুরুষ করবে আর ঘরের হাল্কা কাজগুলো নারীরা করবে।
৫. নারী-পুরুষের ভিন্নতা অলংঘনীয়। এই প্রাকৃতিক ভিন্নতাকে গ্রহন করেই আমরা সবাই মানুষ। Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination against Women (CEDAW) এর প্রাককথনের চতুর্থ প্যারার ‘As defined in article 1, discrimination is understood as any distinction, exclusion or restriction made on the basis of sex…in the political, economic, social, cultural, civil or any other field.’ - এ অংশটুকু নিতান্তই বাড়াবাড়ি নয়কি?
[URL: http://www.un.org/womenwatch/daw/text/econvention.htm on 07th April, 2011]
৬. বৈষম্য (ডিসক্রিমিন্যশান) –এর প্রকৃত অর্থ হওয়া উচিত নারীর উপর পুরুষ কর্তৃক একতরফাভাবে আরোপিত অন্যায্য ও বঞ্চনামূলক বিষয়াদি। আসুন, সেসব চিহ্তি ও প্রতিরোধ করে মানবিক সমতাকে নিশ্চিত করি।
৭. সকল ক্ষেত্রে সমতা – একটি কষ্টকর কল্পনা মাত্র। মানবিক সমতা সত্বেও আইনের ইক্যুইটিবল ডিস্ট্রিবিউশন একটি অপরিহার্য বিষয়। ইক্যুইটি ইজ দ্য ট্রু সেন্স অফ ইকোয়ালিটি। যেটি হচ্ছে ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের মর্মবাণী।
আপনাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গবেষণা কেন্দ্র, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আয়েোজিত সেমিনারে (১১/০৪/২০১১) পঠিত